ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪

ফুলেফেঁপে উঠেছে এমপি জাফর আলমের সম্পদ

সরকারি জমি ও চিংড়ি ঘের দখল পাহাড় কাটা মাদক ব্যবসা এবং চাঁদাবাজির অভিযোগ
অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ তদন্ত করছে দুদক
অস্ত্রধারী নিয়ে মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে সম্প্রতি আলোচনায় তিনি

সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম ইব্রাহিম খলিল মামুন, কক্সবাজার ::

নেতাকর্মীর পেছনে দেদার খরচ করেন তিনি। দু’হাত খুলে দানও করেন। আবার সরকারি জমি, পাহাড়, পুকুর ও চিংড়ি ঘের দখলের অনেক অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে। তিনি কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য জাফর আলম। এমপি হওয়ার পর ফুলেফেঁপে উঠেছে তাঁর সম্পদ। চকরিয়া-পেকুয়ায় তাঁর কথাই যেন আইন! রয়েছে নিজস্ব বাহিনী। পাহাড় কাটা, নদী দখল ও অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে ওই বাহিনীকে কাজে লাগান তিনি। তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে এমপি জাফর আলম বলেন, ‘এসব ষড়যন্ত্রের অংশ। সরকারি সম্পত্তি দখল বা পরিবেশবিধ্বংসী কোনো কাজ করিনি।’ সম্প্রতি অস্ত্রধারীর পাশে দাঁড়িয়ে মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে আলোচনায় এ সংসদ সদস্য।
জাফর আলম চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি। ২০১৮ সালে প্রথম এমপি হন। অল্প সময়ে মালিক হয়েছেন বিপুল অর্থসম্পদের। এমপি হওয়ার প্রথম তিন বছরে তাঁর সম্পদ বেড়েছে ছয় গুণ। তাঁর স্ত্রী শাহেদা বেগম স্কুলশিক্ষিকা। স্বামী এমপি হওয়ার পর ফুলেফেঁপে উঠেছে তাঁর সম্পদও।

অবৈধভাবে বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এমপি জাফর আলম ও তাঁর পরিবারের তিন সদস্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর অংশ হিসেবে গত বছরের সেপ্টেম্বরে দুদকের কক্সবাজার কার্যালয়ে জাফর আলম, তাঁর স্ত্রী শাহেদা বেগম, ছেলে তুহিন আলম ও মেয়ে তানিয়া আফরিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
দুদকের একটি সূত্র বলছে, জাফর আলম ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে সরকারি জমি ও জলমহাল দখল, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি এবং অবৈধভাবে বালু বিক্রি করে ২৩টি দলিলে ২৪ একর জমি নামে-বেনামে কিনে নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া চকরিয়া ও পেকুয়ায় তিনটি মার্কেট রয়েছে তাঁর, গাড়ি রয়েছে কয়েকটি। সব মিলিয়ে অন্তত ১০০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক তিনি। তবে এমপি জাফর আলম বলছেন, ‘এসব ষড়যন্ত্রের অংশ।’

দখল, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা এবং অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এমপি জাফর আলম ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের কথা নিশ্চিত করেছেন দুদকের কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন। এ বিষয়ে এই মুহূর্তে আর কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।

এমপি হওয়ার পর সম্পদ ছয় গুণ

হলফনামা অনুযায়ী, ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনের সময় জাফর আলমের সম্পদ ছিল ১ কোটি ২৬ লাখ ৩০৭ টাকার। এমপি হওয়ার পর থেকে তাঁর সম্পদ বাড়তে থাকে, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে হয় ২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬ কোটি ৩ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। জাফর আলম এমপি হওয়ার পর তাঁর স্কুলশিক্ষিকা স্ত্রী শাহেদা বেগমের সম্পদও বাড়তে থাকে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শাহেদা বেগমের সম্পদ ছিল ১ কোটি ১৩ লাখ টাকার, যা বেড়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে হয় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ কোটি ৭১ লাখ টাকা।

২০১৮ সালে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় জাফর আলম তাঁর নামে নগদ ৪১ লাখ ৪৫ হাজার ও স্ত্রীর নামে মাত্র ৫ লাখ টাকা থাকার কথা উল্লেখ করেন। তখন জাফর আলমের নামে কৃষিজমি ছিল দশমিক ০২৪০ শতক ও অকৃষি জমি দশমিক ০৬৯৫ শতক। স্ত্রী শাহেদা বেগমের নামে কৃষিজমি ছিল দশমিক ০২০ শতক ও অকৃষি জমি দশমিক ০৩০ শতক। এ ছাড়া একটি বাড়ি ও ২০ একর ইজারা নেওয়া জায়গায় একটি চিংড়ি ঘের থাকার কথা তিনি উল্লেখ করেন। তবে এর বাইরেও বেনামে তাঁর কয়েক গুণ সম্পদ রয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।

নিউমার্কেট বানাতে যা করেছেন এমপি

এমপি জাফর আলম পেকুয়ায় সরকারি জলাশয় ও ড্রেন ভরাট করে তাঁর মেয়ে তানিয়া আফরিন ও তাঁর স্বামীর নামে নিউমার্কেট নির্মাণ করেছেন, যার বাজারমূল্য প্রায় আট কোটি টাকা। এই মার্কেট নির্মাণে সদর ইউনিয়নের বাইম্যাখালীর মো. আলমগীরের এক একর জায়গা দখলের অভিযোগ রয়েছে এই সাংসদের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে মামলা চলছে আদালতে। মো. আলমগীর বলেন, ‘২০১৫ সালে জায়গাটি ক্রয় করি। পাঁচ বছর আমার ভোগদখলে ছিল। জাফর আলম এমপি হওয়ার পর ২০২০ সালে আমার সেই জমি দখল করে মার্কেট নির্মাণ শুরু করেন। তাঁর ক্যাডার বাহিনীর কাছে তখন অসহায় ছিলাম। পরে এ ব্যাপারে আদালতে মামলা করি।’ এই মার্কেট নির্মাণে পেকুয়া ইউনিয়ন পরিষদসংলগ্ন ৬০০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৫ মিটার প্রস্থের রাস্তাটিও দখল করার অভিযোগ উঠেছে এমপির বিরুদ্ধে। এতে ১২-১৫টি পরিবার অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। এ নিয়ে অভিযোগ পাওয়ার কথা জানিয়েছে দুদকের একটি সূত্র।

ক্ষমতার অপব্যবহারে দখল আর দখল

অন্যের জমি দখল করে চকরিয়া পৌরসভা ৪ নম্বর ওয়ার্ডে ছেলে তুহিন ও মেয়ে তানিয়ার নামে আরেকটি মার্কেট নির্মাণ করছেন এমপি জাফর আলম, যার বাজারমূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা। তিনি পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডে গ্রিন ভ্যালির পাশে তানিয়া আফরিনের নামে দুই একর জমি কিনে তা ভরাট করে দখলে নিয়েছেন। এটির মূল্য দুই কোটি টাকার বেশি। তানিয়া আফরিন ও তুহিনের নামে পৌরসভার চিরিংগায় মাল্টিপ্লেক্স নামে আরেকটি মার্কেট রয়েছে তাঁর, যার বাজারমূল্য অন্তত ১৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া ছেলে তুহিনের নামে তিনি তিনটি বিলাসবহুল গাড়ি কিনেছেন বলে জানান স্থানীয়রা।
এমপি জাফরের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ হলো, তিনি চকরিয়া বাস টার্মিনালের পূর্ব পাশে জলাশয় দখল ও ভরাট করে কয়েকজনের কাছে বিক্রি করেছেন। রামপুর মৌজায় গ্রামীণ ব্যাংকের নামে বরাদ্দ ৩০০ একরের চিংড়ি প্রজেক্ট এক চেয়ারম্যানকে দিয়ে রাতারাতি দখল করে নিয়েছেন। বরইতলী-মগনামা সড়কে নবনির্মিত বানৌজা শেখ হাসিনা ঘাঁটি সড়কে মাটি দেওয়ার নাম করে মছনিয়া কাটা এলাকায় সাবাড় করেছেন বিশাল পাহাড়। ছেলেকে মালয়েশিয়ায় পড়ানোর আড়ালে অর্থ পাচারের অভিযোগও রয়েছে এমপি জাফরের বিরুদ্ধে।

রক্ষা পাচ্ছে না খেলার মাঠ

পেকুয়ায় একটি সংযোগ সড়ক নির্মাণের সরঞ্জাম রাখা হয়েছে উপজেলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স মাঠে। এতে খেলার মাঠে আর খেলা হচ্ছে না। দুই বছর ধরে এই অবস্থা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জামিল ইকবালের দাবি, এমপি জাফরের নির্দেশনায় অস্থায়ীভাবে তারা সেখানে নির্মাণসামগ্রী রেখেছেন। তবে স্থানীয় ক্রীড়ামোদীরা বলছেন, বড় লেনদেনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে খেলার মাঠটি ব্যবহার করতে দিয়েছেন এমপি জাফর। পুরো মাঠে এখন ইট-বালু ও কংক্রিটের স্তূপ। জিমনেশিয়ামটি থাকার জন্য ব্যবহার করছেন শ্রমিকরা।

বিভক্ত স্থানীয় আওয়ামী লীগ

অভিযোগ রয়েছে, মতের অমিল হলে দলের লোককেও ছাড় দেন না সংসদ সদস্য জাফর আলম। তাঁর কারণে চকরিয়া-পেকুয়ায় আওয়ামী লীগে বিভক্তি। নৌকা প্রতীকে ভোটে জয়ী হলেও এখন দলের নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না তিনি। কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য এস এম গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘গেল ইউপি নির্বাচনে এমপি জাফরের কারণেই নৌকার অধিকাংশ প্রার্থীর পরাজয় হয়েছে। চকরিয়া-পেকুয়ার আওয়ামী লীগে গ্রুপিংয়ের জন্যও দায়ী এমপি।’ চকরিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপিত ফজলুল করিম সাঈদির অভিযোগ, ‘চকরিয়া-পেকুয়ার আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীকে বাদ দিয়ে বিএনপি-জামায়াতের লোকজন নিয়ে নিজস্ব বলয় তৈরি করেছেন এমপি জাফর আলম। তাদের দিয়ে এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা তিনি করছেন না।’

ফজলুল করিম বলেন, ‘এমপি তাঁর বাহিনী দিয়ে শতকোটি টাকার জমি দখল করেছেন। প্যারাবন কেটে দখল করেছেন অন্তত দুই হাজার একর চিংড়ি চাষের জমি। নদীতে অবৈধভাবে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছেন।’ কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সালাহ উদ্দিন আহমেদ সিআইপি বলেন, জাফর আলম এমপি হওয়ার পর চকরিয়া-পেকুয়ার সন্ত্রাসী-অস্ত্রধারী ও ডাকাতদের নিয়ে ‘জাফর লীগ’ গঠন করেছেন। জায়গা দখল, পাহাড় কাটা ও নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে তাঁর বাহিনী। এমন কোনো অপরাধ নেই যেটি তাঁর বাহিনী করছে না। ভয়ে কেউ মুখও খুলতে পারছেন না।

অস্ত্রধারীদের নিয়ে মিছিল

চকরিয়ায় মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর গায়েবানা জানাজা ঘিরে সংঘর্ষের সময় মিছিলে অস্ত্রধারীদের সঙ্গে ছিলেন এমপি জাফর আলম। সেই মিছিল থেকে করা গুলিতে একজন প্রাণ হারিয়েছেন। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, সাদা পাঞ্জাবি পরা সংসদ সদস্য জাফরকে মাঝখানে রেখে শহরে মিছিলটি হয়। মিছিলের সামনে হেলমেট, হাফহাতা শার্ট ও কালো প্যান্ট পরা এক ব্যক্তির হাতে ছিল ভারী অস্ত্র। তার পেছনে ছিলেন জাফর আলম, তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী আমিন চৌধুরী, পৌরসভা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলমগীর ও পৌরসভা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক আহ্বায়ক জয়নাল হাজারী। তাদের পাশে কালো পাঞ্জাবি ও হেলমেট পরা আরেকজনের হাতে অস্ত্র হাতে দেখা যায়।
চকরিয়া পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘গায়েবানা জানাজার দিন জাতীয় শোক দিবস হওয়ায় মহাসড়কে এমপির নেতৃত্বে শান্তি মিছিল হয়।’ তবে মিছিলে অস্ত্রধারীদের বিষয়ে কিছু জানেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

যা বললেন এমপি জাফর আলম

অবৈধভাবে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এমপি জাফর আলম।  তিনি বলেন, ‘আমার আয়কর নথিতে সম্পদ কিছুটা বেড়েছে। এমপি হওয়ার পর এই বাড়াটা স্বাভাবিক। আমি এখন বেতন-ভাতা পাই সংসদ থেকে। আমার সন্তানরাও বড় হয়েছে। এক সন্তান মালয়েশিয়ায় পড়াশোনা করছে। আমার মেয়ের জামাই বুয়েটের স্বনামধন্য শিক্ষক।’ ছেলে স্টুডেন্ট ভিসায় মালয়েশিয়া গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তার মাধ্যমে টাকা পাচার করার কোনো সুযোগ নেই। সেকেন্ড হোম করার প্রমাণ কেউ দিতে পারলে এমপি পদ ছেড়ে দেব। আসলে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এলাকায় আমি জনপ্রিয়। দুই হাতে মানুষের জন্য দান করি। এটি সহ্য হচ্ছে না অনেকের।’ সরকারি সম্পদ দখল কিংবা পরিবেশবিধ্বংসী কোনো কাজ করেননি বলে দাবি করেন এমপি জাফর আলম। চ্যালেঞ্জ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এটারও কোনো প্রমাণ নেই কারও কাছে। বলা হচ্ছে, আমি শতকোটি টাকার মালিক। কেউ এর প্রমাণ দিক। দুদকও যদি প্রমাণ দিতে পারে, রাজনীতি ছেড়ে দেব। এরই মধ্যে দুদক তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। দেখবেন, শেষ পর্যন্ত সত্যের বিজয় হবে।’ সমকাল

পাঠকের মতামত: